জেলা পরিচিতি
ভৌগলিক পরিচিতি
বৃহত্তর যশোর জেলা ৮৮°৪০’ হতে ৮৯°৫০’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২২°৪৭’ হতে ২৩°৪৭’ উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত। যশোর একটি মৃতপ্রায় ব-দ্বীপ, পদ্মা ও হুগলী নদীর মধ্যবর্তী সুবৃহৎ ব-দ্বীপটির একটি অংশ হচ্ছে যশোর। অল্পকথায় গংগা ও ব্রক্ষ্মপুত্রের মধ্য ভাগে ব-আকৃতির জায়গাকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সমান তিনভাগে ভাগ করলে মধ্য ভাগের পশ্চিম-উত্তর ও দক্ষিণপূর্ব অংশ ছাড়া অবশিষ্ট্র অংশ যশোর। তৎকালে জেলার দৈর্ঘ্য ছিল ২৪৪ কিলোমিটার বা ১৪০ মাইল এবং প্রস্থ ৭৬.৮ কিলোমিটার বা ৪৮ মাইল। সেমোতাবেক আদি যশোরের আয়তন ছিল ১৪৫৬০বর্গকিলোমিটার বা ৫৬০০ বর্গমাইল। যার মধ্যে ৪৪৬১.৬ বর্গকিলোমিটার বা ১৭৬০ বর্গমাইল সুন্দরবন অংশ। এ কালপর্ব থেকে প্রাক-পাকিস্তান পর্বে যশোর জেলার আয়তন ছিল ৭৬৫০ বর্গকিলোমিটার বা ২৫২৫ বর্গমাইল। বর্তমানে এ জেলায় কোন বনভূমি নেই। যশোর জেলায় অবস্থিত নদী সমূহের মধ্যে ভৈরব, চিত্রা, কপোতাক্ষ, হরিহর, দাদরা, বেত্রাবতী, কোদলা ও ইছামতি অন্যতম।
—–x————-
জেলার পটভূমি
বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডটি প্রাচীনকালে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ইতিহাসে এসব রাজ্য ভাংগা, পান্ডু, সমতট, তাম্রলিপ্ত, বঙ্গ ইত্যাদি নামে পরিচিত। উক্ত সময়ে যশোর সম্ভবত তাম্রলিপ্ত ও ভাংগা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীকালে যশোরসহ সন্নিহিত অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক ও বৈপ্লবিক ইতিহাস বহু উত্থান-পতন আর বিচিত্রতায় পূর্ণ।
গংগা নদীর পলল অবক্ষেপণে সৃষ্ট যশোর জেলার সবচেয়ে পুরাতন বিবরণ পাওয়া যায় টলেমির মানচিত্রে। মহাভারত, পুরান, বেদ ও আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে এ অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ জেলার অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এক সময় এই অঞ্চল গভীর জংগলে পরিপূর্ণ ছিল। অনার্য জাতিবলে পরিচিত এক শ্রেণীর আদিম মানুষ জংগল পরিস্কার করে সর্ব প্রথম এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
যশোর জেলার নামকরণ অনুসন্ধানে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যশোর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। ঐতিহাসিকগণের মধ্যেও এ জেলার নামকরণ সম্পর্কে মতবিরোধ দেখা যায়। সেহেতু এ বিষয়ে কোন একক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে যশোর বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন জেলা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম উল্লেখযোগ্য এ জেলাটির সৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দুইশত বৎসর পূর্বে ১৭৮৬ সালে। পাক-ভারত উপ-মহাদেশে বৃটিশের আগ্রসী রাজত্ব শুরু হওয়ার ফলে যশোরসহ সমগ্র বঙ্গ ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। চিরকালের আপোসহীন সংগ্রামী যশোরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অপারগ হলে ইংরেজ শাসকগণ তাদের শাসন কাজের সুবিধার জন্য যশোরকে একটি ভূখন্ডে নির্দিষ্ট করে তাকে স্বতন্ত্র জেলায় রূপান্তরিত করে। প্রথম প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন যশোর জেলার সীমানা-খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং আজকের চুরাশিপূর্ব অবিভক্ত যশোরসহ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল।
যশোর জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুইশত বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় চারশ বছর পূর্বে ১৬৭৪ থেকে পরবর্তীকালের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যশোর একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল এবং স্বাধীন নৃপতিগণ কর্তৃক শাসিত হত। এক সময়ের ভাটির দেশ বলে পরিচিত তৎকালীন স্বাধীন যশোর রাজ্যের সীমানা-পূর্বে মধুমতি নদী, উত্তরে হরিণঘাটা, পশ্চিমে ভারতের কুশদ্বীপ ও প্রাচীন ভাগীরথী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বিস্তৃত ছিল।
স্বাধীন যশোর রাজ্যের যাঁরা শাসক ছিলেন তাঁদের মধ্যে মহারাজ বিক্রমমাদিত্য, রাজা প্রতাপাদিত্য, রাজা সীতারাম রায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেউ কেউ মনে করেন বিখ্যাত সাধক ও ইসলাম প্রচারক খাঁন জাহান আলী যশোরের স্বাধীন শাসনকর্তা ছিলেন। আবার কেউ বলেন খাজা খাঁন জাহান আলী ছিলেন দিল্লীর সুলতান মামুদ শাহ কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে দিল্লীর সম্রাটগণ কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধি কিংবা স্থানীয় শাসকগণ যশোরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, কিন্তু বার বার সে বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছে।
১৮৬০ সালের কৃষক ও নীল বিদ্রোহের সময় ইংরেজ শাসকদের পক্ষে বিশাল যশোরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা পুনরায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন ইংরেজগণ খুলনা, ঝিনেদা, মাগুরা এবং নড়াইলকে উপ-বিভাগ (মহাকুমা) রূপান্তরিত করে (১৮৬১-৬২)। ১৮৬৩ সালে জেলার দক্ষিণাংশ সাতক্ষীরাকে চব্বিশ পরগণা জেলার সংগে যুক্ত করা হয়। এর দীর্ঘ বিশ বছর পর ১৮৮১ সালে পুনরায় যশোরকে ভেংগে এ জেলার মহকুমা খুলনাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। এই একই সময়ে আবার সাতক্ষীরাকে চবিবশ পরগণা থেকে আলাদা করে নব গঠিত খুলনা জেলার সংগে যুক্ত করে মহকুমায় উন্নীত করা হয়। ১৮৬৩ সালের শেষভাগে পশ্চিম বাংলার বনগ্রাম মহকুমাকে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে যশোরসহ সমগ্র বঙ্গ একটি স্বাধীন এবং শক্তিশালী রাজ্য ছিল। খ্রীস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর টলেমীর মানচিত্রে তার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্তও যশোর বঙ্গের অধীন ছিল বলে অনুমান করা হয়। খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে উত্তর ভারতের গুপ্ত সম্রাজ্যের সমুদ্র গুপ্ত তার সম্রাজ্য বঙ্গদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করলে যশোরসহ সন্নিহিত অঞ্চল তার সম্রাজ্যভুক্ত হয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে গুপ্ত সম্রাজ্যের পতন ঘটলে যশোর পুনরায় ভাংগা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়ের সম্রাট শশাংক কর্তৃক বঙ্গদেশ অধিকৃত হলে যশোর তার সম্রাজ্যভুক্ত হয়। শশাংকের কাছ থেকে সম্রাট হর্ষবর্ধন এ অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেন।
সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে সংক্ষিপ্তকালের জন্য যশোর বৌদ্ধ রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পর নিজ নিজ কর্মফলের উপর মানুষের ভবিষ্যত নির্ভরশীল বৌদ্ধধর্মের এ মূলনীতি এ ধ্বংসস্তুপ তাদের স্মৃতি বহন করে।
রাজা যশোরমণি নামে একজন রাজা বৌদ্ধদের কাছ থেকে এ অঞ্চলের শাসন ভার অধিকার করেন। যশোরমণির পরে পাল রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পাল রাজাগণ ১০৮০ সাল পর্যন্ত যশোরসহ সন্নিহিত অঞ্চল তাদের শাসনক্ষেত্রে অন্তর্ভূক্ত রাখেন। পাল রাজত্বের পর বর্মন রাজাগণ ১১৫০ সালে পর্যন্ত যশোর শাসন করে বলে জানা যায়। এরপর এখানে সেন রাজাগণ তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। সেন রাজাগণ ১২০৪ সাল পর্যন্ত যশোর তাঁদের শাসনকাল অব্যাহত রাখে । লক্ষণসেন এই বংশের শেষ রাজা।
১২০৪ সালে ইখতিয়ারুদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী নামে দিল্লীর সম্রাট শিহাবুদ্দীনের একজন মুসলিম সেনাপতি বংগদেশে সেন রাজ বংশের পতন ঘটিয়ে বংগদেশ অধিকার করেন এবং এই উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয় সে বিষয়ে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়।
চতুর্দশ শতাব্দীর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যশোর ছিল দিল্লীর সম্রাটগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। উক্ত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ নামক একজন স্বাধীন নৃপতি বংগদেশ জয় করলে যশোর তাঁর শাসিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর থেকে এ অঞ্চল পর্যায়ক্রমে স্বাধীন নৃপতিদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে।
১৪৮৭ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটিয়ে দাস বংশ তাদের রাজত্ব শুরু করে। দাসরাজগণ ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এখানে তাঁদের অধিকার টিকিয়ে রাখেন। দাস বংশের পতনের পর যশোর সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহের শাসনাধীন চলে যায়। ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত হুসেনশাহী বংশ এ অঞ্চলের তাঁর শাসনকাল অব্যাহত রাখেন।
পরবর্তীকালের ইতিহাসের অন্যতম প্রসিদ্ধ পাঠান সম্রাট শেরশাহ বঙ্গদেশাধিকার করলে যশোর তাঁর সম্রাজ্যভুক্ত হয়। পাঠান রাজত্বের পর বিখ্যাত মোগল রাজবংশ পাক-ভারত উপমহাদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে তাদের স্মরণীয় শাসনকালের সূচনা করে। এ সময় বিখ্যাত মোগল সম্রাট আকবর প্রথম এই অঞ্চলে ফৌজদার নিযুক্ত করে শাসনের ব্যবস্থা করেন। যশোরের প্রথম ফৌজদার ছিলেন ইনায়েত খাঁ। এরপর সরফরাজ খাঁ, নুরুল্লা খাঁ পর্যায়ক্রমে যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত হয়ে আসেন।
নবাবী শাসনামলে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর শাসনকালে সীতারাম রায় নামক একজন স্থানীয় রাজা কর্তৃক যশোর শাসিত হত। সীতারাম ছিলেন উত্তর রাঢ় বংশীয় কায়স্থ। তার পিতা উদয় নারায়ণ ভূষণার ফৌজদারের অধিনে একজন তহশীলদার ছিলেন। রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানী ছিল মহম্মদপুর।
রাজা সীতারাম রায় মুর্শিদকুলী খাঁকে অমান্য করলে নবাব তার বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে সীতারাম রায় পরাজিত হন। সীতারামের পতনের পর যশোর কয়েকটি জমিদারীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। নাটোরের জমিদার জেলার পূর্বাংশ, চাঁচড়ার জমিদার জেলার দক্ষিণাংশ এবং নলডাংগার জমিদার উত্তরাংশ তাদের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে গৌড়ের শাসনকর্তা দাউদের একজন বিশ্বস্ত সহযোগী শ্রীহরি ১৫৭৪ সালের যশোরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং স্বাধীন যশোর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসে এই শ্রীহরিই মহারাজ বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত। বিক্রমাদিত্য গৌড়ের রাজা দাউদ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি। বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ঈশ্বরপুর এবং তেকাটিয়া ছিল বলে জানা যায়। ১৫৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বিক্রমাদিত্য মৃত্যুবরণ করেন। বিক্রমাদিত্যের শাসনকালে তার বিশ্বস্ত সহযোগী ও জ্ঞাতিভ্রাতা বসন্ত রায়ই যশোরের প্রকৃত শাসক ছিলেন। গৌড় থেকে লুট-করা অঢেল ধন-সম্পদ দ্বারা যশোরকে বসন্ত রায়ই ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গড়ে তোলেন।
বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ১৫৮৭ সালে তদীয় পুত্র প্রতাপাদিত্যকে বসন্ত রায় যশোরের রাজা বলে ঘোষণা করেন। প্রতাপাদিত্যের প্রকৃত নাম গোপীনাথ। ১৫৬০ সালে তিনি গৌড়ে জন্মগ্রহণ করেন। প্রতাপাদিত্য তার প্রাপ্ত উপাধি। সুন্দরবন অঞ্চলের ধুমঘাট ছিল প্রতাপের রাজধানী। ১৪০০ সালের দিল্লীর সম্রাট নাসির শাহ অথবা মাবুদ শাহ খাজা জাহান বা খাঁন জাহান আলী নামক একজন উচ্চপদস্থ সহযোগীকে জায়গীর প্রদান করে বঙ্গদেশে প্রেরণ করেন। খাজা জাহান বা খাঁন জাহান আলী সম্রাট মামুদ শাহ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি। তাঁর প্রকৃত নাম উলুঘ খাঁন। বংগদেশে এসে খাঁন জাহান আলী যশোর অঞ্চলের শাসনভার প্রাপ্ত হন এবং দেশ শাসন এবং ইসলাম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন বিখ্যাত ইসলামী সাধক ও ধর্ম প্রচারক হিসাবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক এই খাঁন জাহান আলীকে জৌনপুর রাজ্যের অধিবাসী ও প্রতিষ্ঠাতা এবং সেখান থেকে তিনি এদেশে আগমন করেন বলে অনুমান করেন। যশোর শহরে সমাধিস্থ হযরত গরীব শাহ ছিলেন খাঁন জাহানের অন্যতম প্রধান সহযোগী। যশোরের পয়গ্রাম কসবা খাঁন জাহান আলীর রাজধানী ছিল। প্রাচীন যশোরের বাগেরহাটে খাঁন জাহান আলীর সমাধি এবং তাঁর বহু কীর্তি চিহ্ন আজও তাঁর স্মৃতি বহন করছে।
১৭৫৭ সালে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উ-দৌলার পতন ঘটলে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে অস্থায়ীভাবে বন্দী হয়। শুরু হয় ইংরেজ রাজত্ব-চলে বর্ণ বৈষম্যবাদী শাসন। প্রায় দুইশত বছর ইংরেজগণ উপমহাদেশে তাদের শোষণ ও নির্যাতনের শাসনকাল অব্যাহত রাখে।
১৮৫৭ সাথে ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে পরবর্তী কালের নীল বিদ্রোহ, কৃষক সংগ্রাম ও স্বদেশ আন্দোলনসহ অসংখ্য বিপ্লব একের পর এক ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকে। অতঃপর ১৯৪৭ সালে ইংরেজগণ এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়।
১৯৪৭ সনের সেই দেশ বিভাগের সময় যশোরকে তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা দীর্ঘ দুই যুগ এ অঞ্চলকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করে এবং অগ্রাসী রাজত্বের নজীর বিহীন শোষণ ও অপশাসন চালিয়ে যায়।
১৯৪৭ সালে ইংরেজগণ উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়। যাবার আগে তারা এদেশে তাদের অপকৌশলের বীজ প্রোথিত করে যায়। এতে সৃষ্ট হয় দেশ বিভাগের। ফলে অভিভক্ত বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে জন্ম দেওয়া হয় দুটি দেশ-ভারত ও পাকিস্তান। এর মধ্যে পাকিস্তান নামক তথাকথিত দেশটির গঠন ছিল একান্তই অসচেতন ও অবাস্তব চিন্তা চেতনার ফসল যা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।
সাতচল্লিশের সেই দেশ বিভক্তির ফলে অভিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলকে করা হল অস্থায়ী পাকিস্তানের অংশ এবং পশ্চিমাঞ্চলকে ভারতে। এর মধ্যে সীমানারেখা নির্ধারণের ফলে আবার পরিবর্তন হল জেলা যশোরের ভৌগলিক অবস্থানের। এতে যশোরের বনগ্রাম মহকুমাকে পুনরায় ভারতের সংগে যুক্ত করা হয়।
১৮৭৬ থেকে ১৯৮৪ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে যশোরের গঠন ও পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া। ১৯৬০ সালে জেলার মাগুরা মহকুমার মহম্মদপুর থানার অংশ এবং নড়াইলের আলফাডাংগা থানাকে ফরিদপুর জেলার সংগে যুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক উন্নয়নকল্পে আজকের যশোরকে ভেংগে পুনর্গঠন করেছে। ফলে জেলার চার মহকুমা নড়াইল, মাগুরা,ঝিনেদা এবং সদর স্বতন্ত্র চারটি জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ আবার এ জেলার সীমানা ও প্রশাসনিক বিভক্তি ঘটেছে। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তিত হতে হতে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীন যশোর জেলা আজ শুধুমাত্র তার একটি খন্ডিত অংশ নিয়ে টিকে আছে। ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যশোরসহ সন্নিহিত অঞ্চল বহু উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন শাসক ও শাসিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত থেকেছে।
১৯৭১ সালে বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও মানবতাবাদী নেতা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংগালীরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ্য নিরপরাধী মানুষকে পাকিস্তানী হায়েনারা নৃশংসভাবে হত্যা করে ইতিহাসের সর্ব বৃহৎ ও ভয়াবহ গণহত্যার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যা মাইলাই হত্যাকান্ডের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল। সেই সংগে তাদের নারী নির্যাতনের পৈশাচিকতাও অতীতের সকল নারকীয়তাকে হার মানায়।
বাংলাদেশের ইতিহাস ইংরেজ বিতাড়ন, পাকিস্তানী উচ্ছেদ, নীল বিদ্রোহ, তে-ভাগা আন্দোলন, কৃষক সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রণী যশোরের সংগ্রামী মানুষ ন্যায়ের স্বপক্ষে অধিকার আদায়ের বিপ্লবে তাদের বলিষ্ট উচ্চারণ রেখেছে বার বার। স্বভাবতই সংস্কৃতির পীঠস্থান এই যশোরের রয়েছে গৌরবময় অতীত যা ভবিষ্যত বংশধরদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
আবহমানকাল ধরেই যশোরের জনগণ বীর ও স্বাধীনচেতা। দেশ ও জাতির যে-কোন দুর্যোগময় মুহূর্তে যশোরের মানুষ জীবন বিপন্ন করে ঝাপিয়ে পড়েছে চেতনার উদ্বুদ্ধতায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যশোর বাসীর অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয় যশোর থেকেই।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে আজকের যশোর তারই একটি সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং তার প্রকৃত অস্তিত্ব লাভ করে।
তথ্য সূত্র
১। যশোরের ইতিহাস-মনোরঞ্জন বিশ্বাস
২। যশোরের ইতিহাস-আসাদুজ্জামান আসাদ